“মেঘালয়ের হানিমুন-মার্ডারের কিনারা?”-‘মিশন ইমপসিবল’ স্টাইলে রাজা রঘুবংশী হত্যা রহস্য উন্মোচন

হলিউড ব্লকবাস্টার ‘মিশন ইমপসিবল’-এর সেই বিখ্যাত সংলাপ যেন বাস্তবে রূপ পেল মেঘালয় পুলিশের হাত ধরে। “ইওর মিশন শুড ইউ চুজ় টু অ্যাকসেপ্ট ইট” – এই চ্যালেঞ্জই যেন গ্রহণ করেছিলেন আইপিএস ও পুলিশ সুপার বিবেক সিইয়েম। দুই রাজ্য জুড়ে এক সপ্তাহব্যাপী এক দুরূহ অভিযানে তাঁর দল কেবল ‘অ্যাকসেপ্ট’ই করেনি, বরং ‘ইমপসিবল’-কে ‘পসিবল’ করে দেখিয়েছে। সোনম রঘুবংশীর স্বামী রাজা রঘুবংশী খুনের চাঞ্চল্যকর রহস্য উন্মোচন করেছেন এই অদম্য পুলিশ সুপার ও তাঁর দল। এনডিটিভিকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বিবেক সিইয়েম এই অবিশ্বাস্য অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।

বিবেক সিইয়েম জানান, “আমরা প্রথমে ধরেই নিয়েছিলাম ওই দম্পতিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে এলাকার ঘটনা, সেই এলাকা বড় দুর্গম। তা ছাড়া ওই এলাকা থেকে আগেও নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে।” শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, রাজা ও সোনম হয়তো বাইক দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দল ও পুলিশের একাধিক টিম দুর্গম এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি শুরু করে। কিন্তু তল্লাশির দ্বিতীয় দিনে যখন ২৯ বছর বয়সী রাজা রঘুবংশীর মৃতদেহ উদ্ধার হলো, তখন তা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা বুঝতে পারলেন – এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিষ্কার খুন।

ঘটনাটিকে নিছক দুর্ঘটনা থেকে হত্যাকাণ্ডে মোড় নিতেই একটি বিশেষ তদন্ত দল (Special Investigation Team) গঠন করা হয়। দলটি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নমুনা সংগ্রহ করে। একটি স্কুটি, একটি রেনকোট, একটি ব্যাগ এবং কিছু ওষুধপত্র উদ্ধার হয়, যা তদন্তের প্রাথমিক সূত্র হিসেবে কাজ করে। এরপরই মেঘালয় পুলিশ সময় নষ্ট না করে সাত দিনের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে তদন্তকারীদের দুটি দল পাঠিয়ে দেয়। স্থানীয় পুলিশের সহায়তা এই অভিযানকে আরও গতিশীল করে তোলে।

গোয়েন্দা দলের তদন্তের মূল ভিত্তি ছিল প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ। সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে সোনমের মোবাইল ফোন নম্বরের কল ডিটেলস সংগ্রহ করে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা হয়। এর সূত্র ধরেই রাজ কুশওয়াহা নামের এক যুবকের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়। একই ভাবে রাজ কুশওয়াহা এবং তার তিন বন্ধুর (যারা পরে আততায়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়) মোবাইল ফোনের বিস্তারিত কল রেকর্ডস ও টাওয়ার লোকেশন সংগ্রহ করা হয়। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে খুনের আগে ও পরের ঘটনাগুলো নিশ্চিত হওয়া যায়। এই সব সূত্র ধরেই মেঘালয় পুলিশের তদন্তকারী দল উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে পৌঁছে যায় এবং দ্রুত অপরাধীদের জাল গোটাতে সক্ষম হয়।

তদন্তে জানা গেছে, রাজা রঘুবংশী (২৯) এবং সোনম রঘুবংশীর (২৪) আসলে গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সোনম বারবার তাদের গন্তব্য বদলাতে থাকেন। প্রথমে শিলংয়ের একটি গেস্ট হাউসে ওঠেন তারা। সেখান থেকে একটি স্কুটি ভাড়া করে তারা চেরাপুঞ্জির দিকে রওনা দেন। সোনম ঝর্ণা ও ট্রেকিংয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করেন।

২২শে মে রাতে রাজা ও সোনম নংরিয়াটের শিপারা হোম স্টে-তে উঠেছিলেন ডাবল ডেকার ব্রিজ দেখার উদ্দেশ্যে। পরদিন ২৩শে মে সকালে, ব্রেকফাস্ট না করেই দু’জনে সকাল ৬টা নাগাদ হোম স্টে থেকে বেরিয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন হোম স্টে-র মালিক সিয়ান্তি সোখলেট।

বেলা ১০টা নাগাদ অ্যালবার্ট পিডি নামে স্থানীয় এক গাইড রাজা ও সোনমকে অজ্ঞাতপরিচয় তিনজন ব্যক্তির সঙ্গে পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখেছিলেন। সেটাই ছিল রাজাকে শেষ দেখা। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান, এবং তার মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর শুরু হয় এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত। বিবেক সিইয়েম এবং তাঁর দলের অসাধারণ তদন্ত দক্ষতাই এই ‘অসম্ভব’ মিশনকে ‘সম্ভব’ করে তুলেছে।