“চাকরি খুইয়ে, এক পা হারিয়েও ছাড়েননি হাল”-প্রহ্লাদ এখন লক্ষাধিক ফলোয়ারের ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’

সিনেমার পর্দায় আমরা প্রায়শই দেখি কীভাবে মানুষ মনের জোরে জীবনের চরম প্রতিকূলতা থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু চোপড়ার প্রহ্লাদ সিংহের জীবন কাহিনি যেন সেই সব চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। এক সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে এবং স্বপ্নের চাকরি খুইয়েও তিনি হাল ছাড়েননি, বরং সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে এখন তিনি লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা।
ছোট থেকেই প্রহ্লাদের স্বপ্ন ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। সেই লক্ষ্যে তিনি নিজেকে প্রস্তুতও করছিলেন। ততদিনে তাঁর বিয়েও হয়ে গিয়েছিল। এরপর একদিন সেই বহু প্রতীক্ষিত নিয়োগপত্র আসে— ইন্দো-টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ থেকে। স্ত্রীকে ফোন করে উচ্ছ্বসিত প্রহ্লাদ বলতে পেরেছিলেন, “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি রমা শুনছ…!” কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এক লহমায় তাঁর সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
সেই সুখবরটি পাওয়ার পরই একটি স্মার্টফোন কিনতে ছোটেছিলেন প্রহ্লাদ। চোপড়ার সোনাপুরে স্মার্টফোন কিনতে গিয়ে রাজ্য সড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি চিরতরে একটি পা হারান। স্বপ্নের চাকরি তো গেলই, সঙ্গে নেমে আসে চরম অভাব। এই পরিস্থিতিতে যে কোনো মানুষের জীবন থমকে যেতে পারত। কিন্তু প্রহ্লাদ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর জীবনের গল্পটা তিনি নিজেই লিখবেন।
শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠার পর প্রহ্লাদ একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মাত্র ন’মাসের মধ্যেই তাঁর সেই পেজের ফলোয়ারের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। একসময় যে প্রহ্লাদের নিজস্ব স্মার্টফোন ছিল না এবং যিনি বন্ধুর মারফত চাকরির খবর পেয়েছিলেন, সেই তিনিই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন পরিচিত ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’। কেউ কেউ তাঁকে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবেও চেনেন।
লাজুক কণ্ঠে প্রহ্লাদ জানান, শুধুমাত্র ফেসবুক থেকে আসা আয় দিয়েই এখন দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার ভালোই চলছে। তাঁর কথায়, “এখন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সত্যিই খুব সুখে আছি।”
দুর্ঘটনার পর দুশ্চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়লেও প্রহ্লাদ হার মানেননি। এই ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতাই তাঁকে নতুন জীবন দান করে। প্রথমদিকে তিনি নিজের ফেসবুক পেজে জীবনে ভেঙে না পড়ার বার্তা দিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাঁর ভিডিওগুলির ভিউ বাড়তে থাকে। এরপর কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে তিনি চলাফেরা শুরু করেন।
“আর্টিফিশিয়াল তো কী হয়েছে!” এই মন্ত্রেই প্রহ্লাদ তাঁর ভিডিওর বিষয়বস্তুকে মোটিভেশনের পাশাপাশি নাচের দিকেও নিয়ে আসেন। তাঁর স্ত্রী রমা রায় সিংহ তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দেন। বর্তমানে এই দম্পতি নাচের ভিডিও আপলোড করে বেশ জনপ্রিয়তা কুড়োচ্ছেন। এই জনপ্রিয়তা থেকে আসা আয় দিয়েই তাঁরা সংসার সামলাচ্ছেন। সম্প্রতি হাপতিয়াগছে নিজেদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁইও হয়েছে তাঁদের।
কিছুদিন আগেই একটি রিসর্টের সামনে রাস্তায় এই দম্পতির নাচের ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছিল। প্রহ্লাদ বলেন, “এভাবেই নাচ, গান, আনন্দ করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।”
চোপড়ার সমাজকর্মী তথা কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মী বাপন দাস প্রহ্লাদকে নিয়ে গর্বিত। তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে প্রহ্লাদের মাঝেমধ্যেই কথা হয়। ওর সঙ্গে কথা বলে মনে জোর পাই।” প্রহ্লাদও বিপদে কখনও ভেঙে না পড়ার বার্তা দিয়ে চলেছেন, যা নিঃসন্দেহে হাজারো মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখাচ্ছে।