পড়ার দাবিতে বাবার বিরুদ্ধে থানায় দুই শিশুকন্যা, হতবাক আলিপুরদুয়ার

“বই খোল!”—এমন নির্দেশ সচরাচর অভিভাবকদেরই দিতে শোনা যায়। খেলাধুলায় মগ্ন কচিকাঁচাদের পড়াশোনার টেবিলে বসাতে বাবা-মায়ের রীতিমতো কালঘাম ছোটে। স্কুলের পড়াশোনায় সন্তান যাতে পিছিয়ে না পড়ে, তার জন্য চলে নানা রকম প্রচেষ্টা, কখনও কখনও বা চকোলেট-আইসক্রিমের মতো লোভনীয় পুরস্কারের টোপও দিতে হয়। তবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ঘটনা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। আলিপুরদুয়ারের দুই খুদে শিশু খোদ তাদের বাবার বিরুদ্ধে পড়াশোনায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে সরাসরি পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে। পুলিশ কাকুদের কাছে তাদের নালিশ, বাবা তাদের শুধু পড়তেই দেন না, এমনকি তাদের বইপত্রও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছেন! আলিপুরদুয়ারের শামুকতলা থানা এলাকার এই ঘটনা পুলিশ ও প্রশাসনকে হতবাক করেছে। স্কুলছুটের হার এবং মোবাইল ফোন আসক্তির এই যুগে দুই শিশুর পড়ার প্রতি এমন গভীর আগ্রহ শিক্ষামহলে নতুন করে আশার আলো জাগিয়েছে।

আলিপুরদুয়ার জেলার ২ নম্বর ব্লকের শামুকতলা থানা এলাকার ধর কলোনির বাসিন্দা এই দুই বোন। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা থেকেই তারা সরাসরি পুলিশের কাছে আসে। দুই বোনের মধ্যে ছোটজন প্রথম শ্রেণির ছাত্রী এবং বড়জন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। উভয়েই পড়াশোনা করতে খুব ভালোবাসে। তাদের অভিযোগ, তাদের বাবা তাদের পড়াশোনায় তীব্র বাধা দেন। যখনই তারা বই নিয়ে বসে, তখনই তিনি বকাবকি শুরু করেন। ঠিকমতো স্কুলে যেতেও দেন না। এছাড়াও, তিনি বেশিরভাগ সময়েই তাদের মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেন। ছোট দুই বোন থানায় এসে পুলিশের কাছে তাদের বাবার বিরুদ্ধে এই সমস্ত অভিযোগ জানিয়েছে।

শিশুদের অভিযোগ শোনার পর পুলিশ তাদের মা ও বাবাকে ডেকে পাঠায়। প্রথমে বাবা অভিযোগগুলো অস্বীকার করলেও পরে তিনি মেয়েদের আনা সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করে নেন। ভবিষ্যতে এমন ভুল আর কখনও করবেন না বলে তিনি হাতজোড় করে আশ্বাস দিয়েছেন। শামুকতলা থানার প্রাক্তন ওসি জগদীশ রায় ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেন, “আমি কিছুদিন আগে শামুকতলা থেকে বদলি হয়েছি। হঠাৎ দেখি দুই ছোট মেয়ে থানায় এসে হাজির। তাদের দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। তাদের মুখ থেকে বাবার দুর্ব্যবহারের কথা শুনে আরও বেশি অবাক হয়েছিলাম। পরে তাদের বাবা-মাকে ডেকে আনা হয়। বাবা প্রথমে অভিযোগ মানতে না চাইলেও পরে সব কথা মেনে নেন এবং ভবিষ্যতে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেন।” যদিও এই ঘটনা প্রসঙ্গে থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়নি।

জানা গেছে, এই শিশু দুটির বাবা একটি খাবারের হোটেলে কাজ করেন এবং মা গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান। স্বামীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে বর্তমানে তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে আলাদা একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তাদের মা বলেন, “আমার স্বামী আমাদের উপর খুব অত্যাচার করে, প্রায়শই মারধর করে। বাচ্চাদের পড়তে দেয় না, ঠিকমতো খেতেও দেয় না। শুধু তাই নয়, ওদের বইগুলো পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি এখন বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা ভাড়া বাড়িতে থেকে প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। আমিও মনেপ্রাণে চাই আমার মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। বাবার এমন অন্যায়ের প্রতিকার চেয়েই তারা পুলিশের সাহায্য চাইতে থানায় গিয়েছিল।”

এই দুই শিশুর পড়াশোনার প্রতি এমন প্রবল আগ্রহের কথা জানতে পেরে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রামের বিধায়ক মনোজ কুমার ওঁরাও। তিনি মেয়ে দুটির পড়াশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিধায়ক বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। যেখানে আমরা অনেক সময় জোর করেও বাচ্চাদের পড়াতে হিমশিম খাই, সেখানে এই ছোট ছোট শিশুরা পড়তে চেয়েও পারছে না এবং এজন্য তাদের পুলিশের কাছে যেতে হয়েছে, এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যের। তাদের বাবা নাকি পড়াশোনা করতে বাধা দেন, বইপত্রও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছেন! এই খবর শুনেই আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওদের পড়াশোনার জন্য যা যা প্রয়োজন হবে, সমস্ত ব্যবস্থা আমরা করব।” জলপাইগুড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান লক্ষ্যমোহন রায় বলেন, “আমাদের জেলায় এমন ঘটনার খবর পাইনি। তবে কিছু অভিভাবক আছেন যারা ছাত্রছাত্রীদের বই কেজি দরে বিক্রি করে দেন। আমরা জেলার প্রত্যেক পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকাকে নির্দেশ দিয়েছি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে, যাতে কোনোভাবেই তারা স্কুল ছেড়ে না দেয়।” তিনি আরও জানান যে তাদের জেলায় স্কুলছুটের হার খুব কম। শেষে তিনি নিজেদের শিক্ষার অধিকার চেয়ে পুলিশের কাছে যাওয়া এই শিশুদের ‘স্যালুট’ জানান।

শামুকতলা থানার বর্তমান ওসি বিশ্বজিৎ দে জানিয়েছেন, তিনি সম্প্রতি এই থানার দায়িত্ব নিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন এবং মেয়ে দুটির পড়াশোনার জন্য সব ধরনের সাহায্যের ব্যবস্থা করবেন।