বিশেষ: বীজ থেকে পাওয়া তেল কি আসলেই ক্ষতিকর?জেনেনিন কি বলছে বিজ্ঞানীরা

ক্যানোলা তেল, ভুট্টার তেল, সূর্যমুখী তেল ও নির্দিষ্ট কিছু গাছের বীজ থেকে তৈরি অন্যান্য পরিশোধিত তেল নিন্দুকদের কাছে ‘হেইটফুল এইট’ হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছেন কয়েকজন স্বাস্থ্যবিষয়ক ইনফ্লুয়েন্সার এমনকি রাজনীতিবিদও।

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ডনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন প্রশাসনের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস’ নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়র। তিনি বলছেন, আমেরিকানরা ‘না জেনেই বিষ পান’ করছেন।

এদিকে, বিভিন্ন অনলাইন ফোরাম, ব্লগ ও ইনফ্লুয়েন্সাররাও এইসব তেলকে ‘এমন বিষাক্ত কিছু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যা ‘আপনাকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলছে’। আর এতে করে ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের মাত্রাও বেড়ে যায় বলে প্রচার করছে ব্লগগুলো। এসব নানা বিষয় উঠে এসেছে মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে।

বীজ থেকে পাওয়া তেল স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, এমন দাবি অনেক পুষ্টি বিজ্ঞানীই নাকচ করে আসছেন, বিশেষ করে যারা একে মাখন এবং চর্বির চেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে দেখেন।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার গার্ডনার বলেছেন, বেশ কয়েক দশকের গবেষণায় দেখা গেছে, বীজের তেলের যোগসূত্র আছে ভালো স্বাস্থ্যের সঙ্গেই।

তিনি আরও যোগ করেন, ‘এর বিপরীতের যে কোনো ধারণা, স্রেফ বিজ্ঞানের অবমূল্যায়ন।”

এইসব তেল কীভাবে আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলে, সে বিভ্রান্তি দূর করতে বিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হয়েছিল টাইমস।

সিড অয়েল বা বীজের তেল কী?

সিড অয়েল বা বীজের তেল শ্রেণিতে পড়ে, এমন তেলগুলোর মধ্যে রয়েছে তুলাবীজ, সয়াবিন, কুসুম, আঙ্গুরের বীজ ও চালের তুষ থেকে তৈরি তেল, যা দিন দিন পরিশোধিত উদ্ভিজ্জ তেলের স্বল্পমেয়াদি বিকল্প হয়ে উঠছে।

এইসব তেল প্রধানত অপরিশোধিত চর্বি থেকে তৈরি হয়, যার মধ্যে বেশিরভাগ তেলেই একটি মিল পাওয়া যায়, তা হল উচ্চমাত্রার ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড। আর শুধু একটিতেই তুলনামূলক কম অর্থাৎ ওমেগা-৩ মাত্রার ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট-এর খাদ্যবিজ্ঞানের অধ্যাপক এরিক ডেকার বলেছেন, এ বীজের তেল বের করতে বীজে চাপ দিতে হয়। তবে, এর প্রক্রিয়াকরণ মাঝপথে থামিয়ে দিলে ‘এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল’-এর মতো ঠাণ্ডা তেল পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন উপকারী উদ্ভিজ যৌগে সমৃদ্ধ। তবে, উচ্চ তাপে রান্না করলে এ তেল পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তিনি আরও যোগ করেন, উৎপাদকরা সাধারণত তাপ ও দ্রাবক দিয়ে এইসব তেল প্রক্রিয়াজাত করে বীজ থেকে আরও তেল তুলে আনে। আর এ কাজের সময় প্রায়শই এমন কিছু উপাদান সরিয়ে ফেলা হয়, যেগুলোতে দুর্গন্ধ বের হওয়ার, তেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার, অপ্রীতিকর স্বাদ বা গাঢ় রং বের হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এই প্রক্রিয়া থেকে একটি নিরপেক্ষ স্বাদের তেল তৈরি হয়, যা তুলনামূলক স্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি সহজে পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছাড়াই উচ্চ তাপে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এমনকি বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি মাত্রায় ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করেন বা যাদের চর্বির মাত্রা রক্তের চেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে কার্ডিওভাসকিউলার রোগ, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও অকাল মৃত্যু’র ঝুঁকি তুলনামূলক কম।

এদিকে, টাফটস ইউনিভার্সিটি’র পুষ্টিবিজ্ঞান ও নীতিমালা বিভাগের অধ্যাপক এলিস এইচ. লিখটেনস্টাইন বলেছেন, বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালে ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে, মানুষ যখন মাখন বা চর্বি থেকে সরে এসে বীজ অথবা অন্যান্য উদ্ভিজ তেল ব্যবহার শুরু করে, তখন ‘এলডিএল’ বা ‘বাজে’ কোলেস্ট্রলের মাত্রা এবং কার্ডিওভাসকিউলার রোগের ঝুঁকি কমে আসে।

তেল ও স্বাস্থ্য নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

বীজের তেল নিয়ে অনলাইনে বেশ কিছু শঙ্কার কথা শোনা গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোর কোনোটিই গবেষণা থেকে আসেনি।

নিন্দুকদের কেউ কেউ দাবি করছেন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের তুলনায় ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের উচ্চমাত্রা শরীরের প্রদাহ বাড়ানোর পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ডেকোটা’র মৌলিক জৈব চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম হ্যারিস বলেছেন, এক্ষেত্রে খুবই সহজ একটি প্রক্রিয়া কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, মানবদেহ থেকে ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড’কে প্রদাহজনক যৌগে রূপান্তর করা হয়। কিন্তু এগুলোকে প্রদাহ বিরোধী যৌগেও পরিবর্তন করা যায়।

গবেষকরা বলছেন, যারা তুলনামূলক বেশি মাত্রায় ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করেন, তাদের রক্তে সাধারণত উচ্চমাত্রার প্রদাহ থাকে না। বরং, তারা আরও স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকেন।

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy