বিশেষ: এই ১০ উপায়ে টাকা নষ্ট করলে সারাজীবন থাকতে হবে অভাবে (১ম পর্ব )

ধনী লোকরা কি সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন উপায়ে টাকা খরচ করে? আসলে টাকা খরচ করা এবং টাকা নষ্ট করার মধ্যে পার্থক্য আছে। আপনি যখন সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী কিছুতে টাকা ঢালবেন – সেটা টাকা নষ্ট করা নয়। এমনকি অঢেল টাকা থাকলে অপ্রয়োজনীয় বিষয়েও মাঝে মাঝে টাকা খরচ করা যায়। কিন্তু আপনার সামর্থ্য নেই, এবং প্রয়োজনও নেই – এমন কিছুতে টাকা খরচ করা মানে টাকা নষ্ট করা।

আবার কোনওকিছু কেনার মত টাকা পকেটে থাকা মানেই কিন্তু সামর্থ্য থাকা নয়। আপনার পকেটে মাস চলার জন্য ৫ হাজার টাকা আছে। মাসের এখনও ১০ দিন বাকি। আপনি সামনে একটি লিমিটেড এডিশন ঘড়ি দেখলেন, যার মূল্য ৩০০০ টাকা। এখন আপনার পকেটে ৩ হাজার টাকার বেশিই আছে – কিন্তু এই ঘড়ি কেনার সত্যিকার সামর্থ্য কি আপনার আছে? – ৩ হাজার টাকা দিয়ে ঘড়িটা কিনে ফেললে আপনার কি অবস্থা হবে? আপনার পকেটে যদি ১ লাখ টাকা থাকে, এবং তার মধ্যে ৮০ হাজার টাকা যদি ঘড়ির পেছনে ব্যয় করেন – সেটাও নিশ্চই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

সামর্থ্য শুধু হাতে থাকা টাকার অংকের ওপরই নির্ভর করে না – এর সাথে আরও কিছু ব্যাপার জড়িত থাকে।

হাতে থাকা টাকাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে মানুষের জীবন ইতিবাচক ভাবে বদলে যেতে পারে। আপনি কত আয় করছেন – তা কোনও ব্যাপার নয়। এই টাকাকেই যদি সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তবে আপনিও হয়তো সত্যিকার ধনী বা অর্থনৈতিক ভাবে মুক্ত হতে পারবেন। কিন্তু টাকাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার না করে নষ্ট করলে সারাজীবনই অভাবে কাটাতে হবে। আপনি যত টাকাই আয় করেন না কেন – টাকার সঠিক ব্যবহার না জানলে জীবনেও অর্থনৈতিক মুক্তি খুঁজে পাবেন না।

আর সেই অর্থনৈতিক মুক্তি ও সত্যিকার সম্পদশালী হতে আপনাকে একটু সাহায্য করতেই আমরা আজ নিয়ে এসেছি ১০টি ক্ষেত্রের কথা। যেসব ক্ষেত্রে টাকা নষ্ট করলে আপনি সারাজীবন টাকার অভাবে কাটাবেন।

০১. ক্রেডিট কার্ড
আজকাল আমাদের দেশে ক্রেডিট কার্ড একটা সামাজিক স্ট্যাটাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটি আসলে একটি বিরাট ফাঁদ।

যে লাইফস্টাইল মেইনটেন করার সত্যিকার সামর্থ্য মানুষের নেই, সেই লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত করে মানুষকে ঋণের জালে আটকে ফেলাই মূলত ক্রেডিট কার্ড কোম্পানীগুলোর উদ্দেশ্য।

এই গর্তে একবার পড়লে মানুষ শুধু গভীর থেকে গভীরেই চলে যেতে থাকে, সেখান থেকে উঠে আসার কোনও পথই থাকে না।

যেই রেস্টুরেন্টে বিল দেয়ার সামর্থ্য নেই, সেই রেস্টুরেন্টে খেতে, যে ডিভাইস কেনার সামর্থ্য নেই – সেই ডিভাইস কিনতে উৎসাহিত করে এই ক্রেডিট কার্ড। টাকা খরচ করার সময়ে বুঝতেও পারে না – এই টাকা তাকে শোধ করতে হবে।

আপনি যখনই ঋণের জালে আটকে যাবেন, তখন আর নিজের জন্য কাজ করবেন না। তখন কাজ করবেন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানীর জন্য।

বিপদে আপদে বা ইমার্জেন্সীতে ধার করা যেতে পারে – কিন্তু লাইফস্টাইল মেইনটেন, বা সামর্থ্যের বাইরে কেনাকাটার জন্য ধার করা মানে টাকা নষ্ট করা। এই অভ্যাস একবার হয়ে গেলে দরকারের সময়ে টাকা হাতে থাকবে না।

কাজেই, ক্রেডিট কার্ড রাখলে সেটা ইমার্জেন্সীর কথা মাথায় রেখে রাখতে পারেন – কিন্তু সেটা দিয়ে বাজে খরচ করলে ফাঁদে পড়ে যাবেন।

০২. পোশাক ও প্রসাধনীর পেছনে বাড়তি খরচ করা
খুব ফিটফাট ব্র্যান্ডের জামাকাপড় পরা, অনেক টাকা খরচ করে চুলের স্টাইল করা এমন বহু লোককে আপনিও হয়তো দেখেছেন – যার পকেটে আসলে টাকা নেই। এরা অনেক সময়েই প্রয়োজনের সময়ে টাকা বের করতে পারে না। – কারণ, প্রয়োজনের টাকা এরা পোশাক, পারফিউম এবং প্রসাধনীর পেছনে খরচ করে ফেলেছে।

এসবের পেছনে অতিরিক্ত টাকা খরচ করলে আপনি জীবনেও সামনে এগুতে পারবেন না। সেলিব্রেটিদের পোশাক, চুলের স্টাইল – এসব সাধারণ মানুষের কপি করতে যাওয়া মানে বোকামী। একজন মানুষের যখন লক্ষ লক্ষ টাকা বাড়তি পড়ে থাকে – সে এসব বিলাশিতা করতে পারে। কিন্তু সেই পর্যায়ে যাওয়ার আগেই যদি কেউ এই কাজ করে – তবে তার আর সেই পর্যায়ে যাওয়া হবে না।

যদি খেয়াল করে দেখেন, তবে দেখবেন জ্যাক মা, ওয়ারেন বাফেট, বিল গেটস – বা এই ধরনের বড় বড় উদ্যোক্তারা বড়লোক হওয়ার আগে যেমন পোশাক পরতেন – ধনী হওয়ার পরও তাঁদের স্টাইলে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আমাদের দেশের লিজেন্ড শেখ আকিজ উদ্দিনের শত শত কোটি টাকা থাকলেও তিনি কিন্তু সেই সাদা পাঞ্জাবী পরেই দিন কাটাতেন।

এমনকি বড় বড় মহিলা উদ্যোক্তা বা নিজের চেষ্টায় ধনী হওয়া নারীরাও খুব একটা জাঁকজমক পূর্ণ পোশাক বা গহনা ব্যবহার করেন না। জে কে রাউলিং বা অপরাহ উইনফ্রে এর গায়ে কখনওই হীরা বা রুবী ঝকমক করে না।

আপনি যখন সত্যি সত্যি বড় হবেন, তখন আপনার চেহারা আর ব্যক্তিত্বই হবে সবচেয়ে বড় অলংকার। কাজেই, গহনা আর পোশাকের পেছনে টাকা আর সময় নষ্ট না করে নিজেকে একটি অলংকারে পরিনত করার চেষ্টা করুন – সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সেরা পোশাকটি কিনুন, কিন্তু এর পেছনে টাকা নষ্ট করবেন না।

০৩. আবেগের বশে কেনাকাটা

ক্রেডিট কার্ড আর ব্র্যান্ডের পোশাক ও প্রসাধনীর বাইরেও মানুষ আবেগের বশে অনেক কিছু কেনে। এবং এতে করে যে কত টাকা নষ্ট হয় – তার হিসাবও কেউ রাখে না।

আবেগের বশে মানুষ কেনাকাটা করে ব্র্যান্ডিং, বিজ্ঞাপন আর ‘ফোমো’ এর ফাঁদে পড়ে। লিমিটেড টাইম অফার দেখে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনেননি – এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।

ফোমো মার্কেটিং মানে মানুষের ‘মিস হয়ে যাওয়ার ভয়’ কে কাজে লাগিয়ে জিনিস বিক্রী করা। ধরুন আপনার ক্ষুধা লেগেছে। একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। ৫০ টাকার একটি আইটেম দেখলেন – যেটি আপনার ক্ষুধা নিবারণ করবে। কিন্তু ওয়েটার এসে বলল, একটি বিশেষ অফার চলছে, যেখানে আপনি ১০০ টাকায় ১৫০ টাকার আইটেম খেতে পারবেন।

আপনি ‘মিস করার ভয়ে’ ১০০ টাকার আইটেম অর্ডার দিয়ে ভাবলেন যে, ৫০ টাকা লাভ হল। কিন্তু আসলে আপনার পকেট থেকে ৫০ টাকা বেশি খসে গেল। অন্যদিকে রেস্টুরেন্টের লাভ হল। যে আইটেমটি আপনাকে ‘ডিসকাউন্ট’ এ খাওয়ানো হল, সেটার হয়তো আগামী কালই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তারা লস করা থেকে বেঁচে গেল।

এ তো গেল একটি উদাহরণ। এমন বহু জায়গাতেই মানুষ আবেগের বশে কেনাকাটা করে ঠকছে। ফোন কেনার সময়েই হয়তো সুন্দর একটি কাভার কিনেছিলেন। এখন মার্কেটে গিয়ে দেখলেন আপনার প্রিয় সুপারহিরোর ছবি দেয়া একটি ফোন কাভার ঝুলছে। এটার কোনও প্রয়োজন না থাকলেও হয়তো আপনি এটা কিনে ফেলবেন। – এভাবে আপনার আবেগকে পুঁজি করে কোম্পানীগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করছে।

বৃটেনে একটি গবেষণায় দেখা যায়, একজন বৃটিশ তার জীবনে ১৫০,০০০ পাউন্ড শুধু এই আবেগের বশে কেনাকাটা করে নষ্ট করে! – আমরাও কিন্তু এর চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই।

আর এই কেনাকাটায় পিছিয়ে না থাকতে গিয়ে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের সবারেই যোগ্যতা আছে নিজের হাতে থাকা অর্থকে কাজে লাগিয়ে আরও ভালো জীবন গড়ার। শুধু এই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

যখনই এমন কিছু কেনার ইচ্ছা হবে – চিন্তা করবেন, এটা আপনার আসলেই প্রয়োজন কি না। যদি আসলেই প্রয়োজন না হয় – তবে যত আকর্ষণীয় অফার আর পন্যই আপনার সামনে আসুক না কেন – সেগুলোর পেছনে টাকা নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন। এই একটি অভ্যাসই আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ।

মনে রাখবেন, পন্য কখনও সুখ দিতে পারে না। টেনশন ফ্রি থাকতে পারাটাই মূল কথা। আবেগের বশে সামর্থ্যের বাইরে আইফোন কিনে যদি সেই টাকার ঘাটতি পূরণের জন্য টেনশন করতে হয় – তবে তা না কেনাই ভালো নয় কি?

০৪.খাবারের পেছনে টাকা নষ্ট করা
মানুষ বাজে খরচ করে যতকিছু নষ্ট করে – তার মধ্যে খাবারের পেছনে টাকা নষ্ট করা অন্যতম।

আপনার যদি আসলেই লক্ষ লক্ষ টাকা বাড়তি পড়ে থাকে, তবে মাঝে মাঝে প্রিয়জনদের নিয়ে ভালো কোনও রেস্টুরেন্টে খেতে পারেন। কিন্তু সামর্থ্য না থাকলেও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে দামী খাবার খাওয়া, আর চেক ইন দেয়ার মানে আপনি এ যুগের বোকাদের একজন।

আত্ম নিয়ন্ত্রণ এবং আত্ম উন্নয়নের জন্য নিজের রসনা বা খাবার ইচ্ছাকে দমন করা খুবই জরুরী। এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। জিহ্বাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে খাওয়ার বদলে প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাওয়া দাওয়া করুন।

ফাস্ট ফুড বা রিচ ফুড আসলে খাদ্য হিসেবে তেমন ভালো কিছু নয়। এগুলোতে অতিরিক্ত চর্বি, তেল, চিনি – ইত্যাদি থাকে।

আমাদের দেশে ফাস্টফুড ‘বড়লোকের’ খাবার বলে বিবেচিত হলেও – এগুলো যেখানে সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে অসমর্থ্য লোকদের টার্গেট করেই সৃষ্টি হয়েছে।

জীবনে উন্নতি করতে গেলে টাকাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন নিজের স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখা।

স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে আপনার শরীর ও মস্তিষ্ক অনেক ভালোভাবে কাজ করবে। আপনি বেশি পরিশ্রম করতে পারবেন এবং মাথা খাটাতে পারবেন – জীবনে বড় হওয়ার জন্য যার কোনও বিকল্প নেই।

০৫. ফিটনেস প্যাকেজ
আজকাল নতুন এক ধরনের পাগলামি শুরু হয়েছে। মানুষ বিরিয়ানী, ফাস্টফুডও খেতে চায়, শুয়ে শুয়ে টিভিও দেখতে চায় – আবার ফিটও থাকতে চায়। যেটা বাস্তবে কখনওই সম্ভব নয়।

কিন্তু মানুষের এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে কিছু কোম্পানী মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

বিশেষ ধরনের চা, জুস, ডায়েট, ব্যায়ামের যন্ত্র (অনেকগুলো শুধু শরীরে লাগিয়ে রাখলেই হয়) – এসব গছিয়ে দিয়ে তারা বোকা মানুষকে আরও বোকা বানাচ্ছে। এগুলো আসলে কোনও কাজই করে না। আপনি ২ বছর বা তারও বেশি বা কম সময় ধরে ২০ কেজি ওজন বাড়িয়েছেন, আর কয়েকটা ক্যাপসুল খেলে আর দিনে ২০ মিনিট উদ্ভট ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করলে সেই ওজন ৩০ দিনে কমে যাবে? – এত সোজা!

এইসব বিজ্ঞাপনে যেসব মডেলকে দেখানো হয়, তারা দিনে অন্তত ৩ ঘন্টা কঠোর শরীরচর্চা করে। কেউ কেউ বছরের পর বছর পনির, মাখন, চকলেট, চর্বি মুখে তোলেনি।

দ্য রক নামে বিখ্যাত হলিউড সুপারস্টার ডোয়েইন জনসন ১৮ বছর চকলেট মুখে তোলেননি। ভারতের জনপ্রিয় নায়ক, বডি বিল্ডিং আইকন জন আব্রাহাম ২০ বছর পর একটি সিনেমার দৃশ্যের জন্য পিজায় কামড় দিয়েছেন।

ফিট এবং সুন্দর হতে গেলে ফিটনেস প্যাকেজ আর পার্লারের পেছনে টাকা খরচ না করে, পরিশ্রম করুন। নিয়ম করে জিমে যান, আর নাহয় বাড়িতে নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। নিজের খাবার অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করুন।

এতে শরীর ফিট থাকবে, টাকাও নষ্ট হবে না। এবং সত্যিকার কাজ করে উন্নতি করার জন্য এনার্জি পাবেন। এটা ১ দিন বা ৩০ দিনের ব্যাপার নয়, নিয়ম করে সাধনা করতে হবে। যেসব প্যাকেজ বা পন্য ৩০ দিন বা ৩ মাসের গ্যারান্টি দেয় – তাদের উদ্দেশ্য শুধু আপনার টাকা হাতিয়ে নেয়া।